Politics

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিশ্লেষণ

download 19

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ভারতের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক পরিসরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যেখানে ইতিহাস, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং সমাজ জীবনের গভীর প্রভাব রাজনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতবর্ষে পশ্চিমবঙ্গ একটি রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সক্রিয় রাজ্য হিসেবে গড়ে ওঠে, যার ভৌগোলিক অবস্থান, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং শ্রমজীবী মানুষের দীর্ঘ সংগ্রামী ইতিহাস এক অনন্য ধারা সৃষ্টি করেছে। একদিকে এই রাজ্য ছিল ব্রিটিশ আমলে বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র, অন্যদিকে স্বাধীনতার পর গণআন্দোলন, কৃষক বিদ্রোহ, ছাত্র আন্দোলন, শ্রমিক ধর্মঘট ও দলীয় রাজনীতির মেলবন্ধন এখানে রাজনৈতিক সচেতনতার এক আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করলে কয়েকটি প্রধান অধ্যায় উঠে আসে—কংগ্রেস যুগ, বামফ্রন্ট যুগ এবং তৃণমূল কংগ্রেস যুগ। এর বাইরে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতীয় জনতা পার্টির উত্থানও রাজ্য রাজনীতিকে নতুন আঙ্গিকে রূপান্তরিত করছে।

কংগ্রেসের শাসন ও প্রথম পর্ব (১৯৪৭–১৯৭৭): স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গের প্রথম সরকার গড়ে তোলে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। এই সময়ে রাজ্যে তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়, কারণ একদিকে দেশভাগ ও শরণার্থী সমস্যা, অন্যদিকে খাদ্য সংকট এবং শিল্পের সংকট সাধারণ মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। প্রাদেশিক রাজনীতিতে সেই সময়ে প্রায়শই ছাত্র-যুবাদের আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, এবং বামপন্থী দলগুলির উত্থান লক্ষ্য করা যায়। কংগ্রেসের শাসনকালে বাংলায় শিল্পাঞ্চল যেমন—কলকাতা, হাওড়া, দুর্গাপুর, আসানসোল ইত্যাদি এলাকায় একাধিক শ্রমিক আন্দোলন হয়। এই সময়েই বামপন্থী শক্তির ভিত মজবুত হতে থাকে, যা ভবিষ্যতে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ভিত্তি তৈরি করে।

বামফ্রন্ট যুগ (১৯৭৭–২০১১): পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে টানা ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড গড়ে বামফ্রন্ট সরকার। ১৯৭৭ সালে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে সিপিআই(এম)-এর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে। ভূমি সংস্কার কর্মসূচি ‘অপারেশন বর্গা’ কৃষক সমাজে গভীর প্রভাব ফেলে। দরিদ্র কৃষকেরা জমির অধিকার পায়, পঞ্চায়েত রাজব্যবস্থা গ্রামীণ প্রশাসনকে নতুন রূপ দেয়, এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে একাধিক সংস্কার চালু হয়। তবে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার ফলে বামফ্রন্টের শাসনকালে শিল্পহীনতা, চাকরির অভাব, শিক্ষিত বেকারত্ব ও রাজনৈতিক হিংসার অভিযোগও বাড়তে থাকে। বিশেষ করে ২০০০-এর দশকে সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন বাম সরকারের জনপ্রিয়তাকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা শেষ পর্যন্ত তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থানের পথ প্রশস্ত করে।

তৃণমূল কংগ্রেস যুগ (২০১১–বর্তমান): মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস বাংলার ক্ষমতায় আসে। “পরিবর্তন চাই” স্লোগান সেই সময় রাজ্যের মানুষকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনীতিতে এক নতুন চেহারা নিয়ে আসেন—গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের পাশে থাকা, জনসংযোগ বাড়ানো, এবং রাজ্যের উন্নয়নে সামাজিক প্রকল্প চালু করা। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সবুজ সাথী, স্বাস্থ্য সাথী ইত্যাদি প্রকল্প বাংলার সমাজ-অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আনে। তবে এই সময়ে রাজনৈতিক হিংসা, দুর্নীতি, শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারি এবং স্বজনপোষণের অভিযোগও উঠেছে। ২০২১ সালের নির্বাচনে বিজেপির বিপুল প্রচারের পরেও তৃণমূল কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে, যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জাতীয় স্তরে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেত্রীতে পরিণত করেছে।

বিজেপির উত্থান: গত এক দশকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিজেপি উল্লেখযোগ্য শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। বিশেষ করে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি রাজ্যে ১৮টি আসন জিতে নেয়, যা রাজনীতির সমীকরণ পাল্টে দেয়। তবে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রত্যাশামতো ফল না পেলেও বিজেপি দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি হিসেবে উঠে আসে। এই উত্থান কেবলমাত্র ভোটের অঙ্কে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে রাজনৈতিক মেরুকরণ তৈরি করেছে। হিন্দুত্ববাদ বনাম বাংলার আঞ্চলিক পরিচয়—এই দ্বন্দ্ব আজ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির অন্যতম বড় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

বর্তমান রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ: পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি বর্তমানে বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন—শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্নীতি, কর্মসংস্থানের অভাব, শিল্পের পশ্চাদপসরণ, স্বাস্থ্য খাতে সংকট এবং ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক হিংসা। একইসঙ্গে পরিচয় রাজনীতি, দলবদল, এবং কেন্দ্রীয় বনাম প্রাদেশিক সংঘাত রাজনীতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। রাজ্য সরকারের উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলির পাশাপাশি বিরোধীদের আন্দোলনও রাজনৈতিক পরিবেশকে প্রতিনিয়ত উত্তপ্ত করছে।

ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ: পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি আগামী দিনে কোন পথে এগোবে তা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। একদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের সামাজিক প্রকল্প ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনভিত্তি, অন্যদিকে বিজেপির সাংগঠনিক বিস্তার ও কেন্দ্রীয় সমর্থন—এই দুই শক্তির মধ্যে প্রধান লড়াই হবে বলেই ধারণা করা যায়। কংগ্রেস ও বামপন্থীরা বর্তমানে দুর্বল হলেও নতুন রাজনৈতিক জোট বা বিকল্প শক্তি ভবিষ্যতে রাজনীতির মেরুকরণ ভাঙতে পারে।

সর্বোপরি, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ভারতের গণতন্ত্রে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এখানে রাজনৈতিক চেতনা শুধু ভোট বা দলীয় সমীকরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমাজ-সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্পকলা ও দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। এটাই বাংলার রাজনীতিকে অনন্য করে তুলেছে।

Add Comment

Click here to post a comment

About Author

admin

আমি প্রদীপ কুমার জানা, পেশায় একজন ব্লগার ও কনটেন্ট ক্রিয়েটর। প্রতিদিন নতুন খবর, সিরিয়ালের আপডেট, এবং ট্রেন্ডিং বিষয় নিয়ে লিখি NewPost.in-এ। আমার লেখা পাঠকদের জন্য তথ্যবহুল ও আপডেটেড রাখতে সবসময় চেষ্টা করি।
আমার ফেসবুক: Serial With Pradip

Log In

Forgot password?

Forgot password?

Enter your account data and we will send you a link to reset your password.

Your password reset link appears to be invalid or expired.

Log in

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.