Politics খবর দেশ ও বিদেশ পশ্চিমবঙ্গ

ভারত ও বাংলার রাজনীতিতে বিজেপির ভূমিকা: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

download 20

ভারতের রাজনৈতিক পরিসরে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি বর্তমানে একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। স্বাধীনতার পরে দীর্ঘ সময় ধরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রভাবশালী আধিপত্য থাকলেও গত কয়েক দশকে বিজেপি ধীরে ধীরে এক শক্তিশালী বিকল্প শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে এবং ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে ভারতীয় রাজনীতির প্রধান ক্ষমতাসীন দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের নেতৃত্বে বিজেপি শুধু কেন্দ্রের ক্ষমতা দখল করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং বিভিন্ন রাজ্যে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি বাড়িয়ে এক সর্বভারতীয় রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলেছে। এই উত্থান কেবলমাত্র নির্বাচনী জয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ভারতীয় সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও এর গভীর প্রভাব পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো ঐতিহ্যবাহী বামপন্থী ও আঞ্চলিক রাজনীতির ক্ষেত্রে শক্তিশালী রাজ্যে বিজেপির উত্থান বিশেষ তাৎপর্য বহন করে, কারণ এখানে দীর্ঘদিন ধরে কংগ্রেস, বামফ্রন্ট এবং পরবর্তীতে তৃণমূল কংগ্রেস রাজনীতি পরিচালনা করেছে। কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ভোট বৃদ্ধি এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভাব রাজনীতির সমীকরণ পাল্টে দিয়েছে।

ভারতের সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপির উত্থান বোঝার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। প্রথমত, বিজেপির আদর্শগত ভিত্তি—যা মূলত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের ওপর দাঁড়িয়ে। এই মতাদর্শ ভারতীয় সংস্কৃতিকে হিন্দু ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত করে দেখতে চায় এবং একইসঙ্গে জাতীয়তাবাদকে ধর্মীয় পরিচয়ের সঙ্গে মিলিয়ে রাজনৈতিক পরিচয় তৈরি করে। দ্বিতীয়ত, বিজেপির সাংগঠনিক কৌশল, যেখানে স্থানীয় স্তর থেকে শুরু করে জাতীয় স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। দলীয় কর্মীরা গ্রামে-গঞ্জে, শহরে, মহল্লায় সক্রিয়ভাবে কাজ করছে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সামাজিক কর্মসূচি, এমনকি দুর্যোগকালীন সাহায্য কার্যক্রমের মাধ্যমেও জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করছে। তৃতীয়ত, বিজেপির নির্বাচনী প্রচার কৌশল—আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, সোশ্যাল মিডিয়া প্রচার, শক্তিশালী স্লোগান এবং মোদীর ব্যক্তিগত ক্যারিশমা বিজেপিকে একটি ব্র্যান্ডে পরিণত করেছে।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই রাজ্যে দীর্ঘদিন হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রভাব প্রায় ছিল না। বাংলার সংস্কৃতি, ভাষা ও বৌদ্ধিক ঐতিহ্য বরাবরই বহুত্ববাদী ও প্রগতিশীল চিন্তার ধারক ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ১৮টি লোকসভা আসন পেয়ে রাজনৈতিক সমীকরণ পাল্টে দেয়। এর প্রধান কারণ ছিল কয়েকটি—(১) তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ, (২) কেন্দ্রীয় প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা, (৩) জাতীয়তাবাদী আবেগ এবং সিএএ-এনআরসি ইস্যুতে প্রচার, (৪) সংগঠিত প্রচারের মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় শক্ত ঘাঁটি তৈরি। যদিও ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি তৃণমূলকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেনি, তবুও ৭৭টি আসন পেয়ে তারা মূল বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটাই প্রমাণ করে যে বাংলার রাজনীতিতে বিজেপি এখন এক অস্বীকারযোগ্য শক্তি।

ভারতের সর্বভারতীয় পরিসরে বিজেপির শাসনকালে বেশ কিছু বড় পরিবর্তন হয়েছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে নোটবন্দি, জিএসটি, আত্মনির্ভর ভারত, মেক ইন ইন্ডিয়া ইত্যাদি কর্মসূচি প্রণীত হয়েছে। সামাজিক দিক থেকে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা যেমন—অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ, তিন তালাক নিষিদ্ধকরণ, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বিলোপ ইত্যাদি কার্যকর করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে মোদী সরকারের ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’, প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক, কোয়াড-এ অংশগ্রহণ, আমেরিকা-রাশিয়া-চীনের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। যদিও এই পদক্ষেপগুলির সঙ্গে সঙ্গে সমালোচনাও রয়েছে। বিরোধীরা অভিযোগ করে যে বিজেপি রাজনীতিকে ধর্মীয় মেরুকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, ভিন্নমতকে দমন করছে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা সংকুচিত করছে।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বর্তমান অবস্থান জটিল। একদিকে তারা শক্তিশালী বিরোধী হিসেবে উপস্থিত, অন্যদিকে রাজ্য সরকার ও শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে তীব্র সংঘাত তৈরি হয়েছে। বিজেপি রাজ্যের জনসংযোগ বাড়াতে বিভিন্ন রকম কর্মসূচি নিচ্ছে, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ, জঙ্গলমহল ও দক্ষিণবঙ্গের গ্রামীণ এলাকায় সাংগঠনিকভাবে নিজেদের শক্তিশালী করছে। তবে চ্যালেঞ্জও রয়েছে—বাংলার আঞ্চলিক পরিচয়, ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের সামঞ্জস্য বজায় রাখা বিজেপির জন্য বড় পরীক্ষা।

ভারতের আগামী দিনের রাজনীতিতে বিজেপির ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। কারণ বর্তমানে বিজেপি একমাত্র সর্বভারতীয় দল, যার সাংগঠনিক বিস্তার উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়েছে। কংগ্রেস দুর্বল, বামপন্থীরা প্রায় বিলুপ্তপ্রায়, আর আঞ্চলিক দলগুলির সীমাবদ্ধতা রয়েছে তাদের নিজস্ব রাজ্যেই। ফলে বিজেপি নিজেকে একটি সর্বভারতীয় বিকল্প শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে এই সাফল্যের পাশাপাশি তাদের সামনে কয়েকটি চ্যালেঞ্জও রয়েছে—অর্থনৈতিক বৈষম্য, কর্মসংস্থান সঙ্কট, শিক্ষার মান উন্নয়ন, স্বাস্থ্য খাতের সমস্যা, আন্তর্জাতিক চাপ, এবং সবচেয়ে বড় কথা গণতন্ত্রের বহুত্ববাদ রক্ষা করা।

সর্বোপরি বলা যায়, বর্তমান বিজেপি ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচনা করছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে তাদের উত্থান প্রমাণ করছে যে তারা এখন সর্বত্র উপস্থিত। তবে ভবিষ্যতে এই উত্থান স্থায়ী হবে কিনা, তা নির্ভর করবে বিজেপি কতটা সফলভাবে উন্নয়ন, সামাজিক সম্প্রীতি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষা করতে পারে তার ওপর। কারণ কেবলমাত্র ধর্মীয় আবেগ বা ব্যক্তিত্ব নির্ভর প্রচার নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নমূলক কর্মসূচিই জনগণের আস্থা অর্জনের মূল চাবিকাঠি।

Add Comment

Click here to post a comment

About Author

admin

আমি প্রদীপ কুমার জানা, পেশায় একজন ব্লগার ও কনটেন্ট ক্রিয়েটর। প্রতিদিন নতুন খবর, সিরিয়ালের আপডেট, এবং ট্রেন্ডিং বিষয় নিয়ে লিখি NewPost.in-এ। আমার লেখা পাঠকদের জন্য তথ্যবহুল ও আপডেটেড রাখতে সবসময় চেষ্টা করি।
আমার ফেসবুক: Serial With Pradip

Log In

Forgot password?

Forgot password?

Enter your account data and we will send you a link to reset your password.

Your password reset link appears to be invalid or expired.

Log in

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.