আজ সকাল থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, একটি গ্রামের বাড়িতে বৌমাকে জনসমক্ষে দণ্ড দেওয়া হচ্ছে শ্বশুরবাড়ির লোকদের দ্বারা। ঘটনাটি ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে এখনো অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক ন্যায়ের বদলে গোষ্ঠীগত ‘পঞ্চায়েত বিচার’ চলে। ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। তাতে দেখা যাচ্ছে, বৌমাটি—নাম ধরা যাক ‘সুমিতা’—একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে অভিযোগের মুখে পড়ে তার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের দ্বারা “বিচার” পাচ্ছেন। তার অপরাধ? সে রাত দশটার পর একটি ফোনে কথা বলেছিল, আর সেই ফোনে কার সঙ্গে কথা হয়েছিল তা নিয়ে পরিবার সন্দেহ পোষণ করে। শুরু হয় মানসিক হেনস্থা, তারপর জনসমক্ষে শাস্তি, যা অনেকটা মধ্যযুগীয় অমানবিকতার মতো।
এই ভিডিওতে শুধু একটি নারীর মান-সম্মান লঙ্ঘিত হওয়ার চিত্রই দেখা যায় না, বরং স্পষ্ট হয় একটি সমাজের কুশিক্ষা, কুসংস্কার আর নারীর উপর আধিপত্যের চরম এক প্রকাশ। ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন নারী অধিকার কর্মী, আইনজীবী ও সেলিব্রিটিরাও মুখ খুলেছেন। অনেকেই বলছেন—এটা ২০২৫ সাল, অথচ এখনো নারীদের স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে এমন প্রহসনের বিচার হয়! বহু ফেসবুক পোস্ট, রিল ও এক্স (টুইটার)-এ এই ঘটনা নিয়ে ক্ষোভের ঝড় উঠেছে। কেউ কেউ ভিডিওটি রিপোর্ট করলেও অনেকেই এটিকে প্রমাণ হিসেবে রেখে দিচ্ছেন, যাতে প্রশাসন এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।
ঘটনার গভীরে গেলে দেখা যায়, সুমিতার স্বামী পেশায় দিনমজুর। তার পরিবারের ধারণা ছিল, বউটির “আধুনিকতা” সংসারে সমস্যা তৈরি করছে। সে কখনো নিজের পছন্দের জামা পরে, কখনো সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট করে। এই সমস্তই কিছু মানুষ এখনও ‘অপরাধ’ হিসেবে দেখে। এমনকি এক প্রতিবেশী ভিডিওতে বলেন, “আজকালকার মেয়েরা নাকি অতিরিক্ত স্বাধীন হয়ে গেছে।” এই ধরনের বক্তব্য শুধু একটি মেয়ের উপর অন্যায় করাকে সমর্থন করে না, বরং গোটা সমাজের মানসিকতা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সেটাই দেখায়।
এই ভাইরাল ভিডিও শুধু একটি নির্দিষ্ট ঘটনার গল্প নয়, বরং এটি বর্তমান সমাজের এক প্রতিফলন, যেখানে নারীর স্বাধীনতা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। আইনের চোখে এসব অন্যায় অপরাধ হলেও, বাস্তবে বহু মানুষ এখনো মনে করে পরিবারের মান-সম্মান রক্ষার্থে নারীকে ‘শাস্তি’ দেওয়া যায়। এই ধরণের মানসিকতা সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা, আত্মহত্যা, দাম্পত্য অশান্তি এবং সন্তানদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন — কোথায় প্রশাসন? কোথায় স্থানীয় পুলিশ? কেন আজও এমন ‘গৃহ আদালত’ চলে?
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ইতিমধ্যেই এই ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলি প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছে, এই ভিডিওটি শুধু শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়, বরং উদাহরণস্বরূপ আইনি পদক্ষেপ হওয়া উচিত যাতে ভবিষ্যতে কেউ এমন কাজ করার সাহস না পায়। পশ্চিমবঙ্গ নারী কমিশনের পক্ষ থেকেও একটি বিবৃতি এসেছে যেখানে বলা হয়েছে, “আমরা এই ঘটনার তদন্ত করব এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করব।”
ঘটনার আরেকটি দিক হলো — সুমিতার মতো হাজারো নারী, যাদের নামই কখনো আলোচনায় আসে না, তারা প্রতিদিন ঘরের কোণে, সমাজের চাপে, পরিবারিক ‘গুরুজনদের’ হাতে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় আসতে পারেন না, কেউ ভিডিও তোলে না, কেউ প্রতিবাদ জানায় না। ভাইরাল ভিডিও আমাদের চোখ খুলে দেয়, কিন্তু আমাদের মন কতটা বদলায় তা সময়ই বলবে।
এমন ঘটনায় সবচেয়ে দুঃখজনক দিক হলো—নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় অনেক সময় নারীরাই অংশ নেয়। ভিডিওতে দেখা গেছে, বয়স্কা শাশুড়ি ও দুই প্রতিবেশী মহিলাও সুমিতাকে অপমান করছেন, যা আবার দেখিয়ে দেয় পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো কীভাবে নারীকেই নারীর শত্রু করে তোলে।
আজকের এই ভাইরাল বিষয় আমাদের শুধু বিচলিত করে না, বরং চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়—আমরা কী সত্যিই এগিয়ে চলেছি? সামাজিক উন্নয়নের কথা যতই বলি না কেন, শিক্ষার আলো যখন সমাজে মূল্যবোধ ও মানবিকতার আলো পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, তখনই এমন ঘটনা ঘটে। এই ভাইরাল ভিডিও একটি প্রতীক — এক সমাজের লজ্জাজনক চিত্র, যেটি শুধু মোবাইল ফোনে থেকে যাবে না, বরং আইন ও সচেতনতার মাধ্যমে বদলানো উচিত।
তাই আজকের এই ভাইরাল বিষয় আমাদের সক্রিয় নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রতিবাদ জানানো, সচেতন হওয়া এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতেই এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। যদি আমরা এখন না বদলাই, তাহলে হয়তো আগামীকাল এই ধরনের ভিডিওর সংখ্যা আরও বাড়বে — আর তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শুধুই আমাদের মানবতা।
পোস্টের সম্ভাব্য ট্যাগস:
#ViralVideo #WomenRights #সামাজিকঅবিচার #নারীঅধিকার #সচেতনতা #HumanRights #BengalNews #BanglaViral
শ্বশুরবাড়িতে বৌমার বিচার – হাড় হিম করা বাস্তব ঘটনা

Add Comment