লাইফ স্টাইল পশ্চিমবঙ্গ ব্যবসা ভ্রমণ

মান্দারমনির হোটেল অভিজ্ঞতা ও সামাজিক বৈষম্যের প্রতিচ্ছবি : Mandarmoni grand beach resort ⛵

IMG 20250824 121001

পার্ট-টাইম হিসাবে আমি টোটো চালাই। টোটো চালানো হয়তো অনেকের চোখে খুব সাধারণ বা তুচ্ছ একটা কাজ, কিন্তু আমার কাছে এটি শুধু একটি উপার্জনের মাধ্যম নয়, বরং জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা অভিজ্ঞতারও উৎস। যেসব অতিথি বা গেস্টদের আমি নিয়ে যাই, তাদের সাথে কথা বলতে বলতে তাদের জীবনধারা, চিন্তাভাবনা ও রুচি সম্পর্কে ধারণা পাই। এর মধ্যেই একদিন ঘটল এমন একটি অভিজ্ঞতা, যা আমাকে ভাবিয়ে তুলল সমাজে লুকিয়ে থাকা সূক্ষ্ম বৈষম্য নিয়ে।

এর আগে বহুবার গেস্টদের নিয়ে আমি মান্দারমনির এক বিখ্যাত হোটেলের ভেতরে ঢুকেছি। তখন টোটো নিয়ে ভেতরে ঢুকতে কোনো বাধা ছিল না। গেস্ট ফোন করলেই আমি ঢুকতাম, অতিথিকে নিয়ে বের হতাম। গেস্টদের জন্য এটুকু ছাড় হোটেল কর্তৃপক্ষ সবসময়ই দিত। এতে গেস্টদেরও সুবিধা হতো—কারণ ভারী লাগেজ বা ছোট বাচ্চা থাকলে অনেক দূর হাঁটতে তাদের অসুবিধা হতো। আমি নিজের টোটো নিয়ে ভেতরে ঢুকতাম, গেস্টদের উঠিয়ে নিয়ে যেতাম, আবার নামিয়ে দিয়ে আসতাম। এতে গেস্টরা যেমন খুশি থাকতেন, আমিও সন্তুষ্ট হতাম।

কিন্তু আজকের দিনটা ছিল ভিন্ন। সকালে আমি একজন গেস্টের ফোন পাই। তিনি আমাকে ডাকলেন হোটেলের গেটে আসতে। আমি আগের মতোই নির্দ্বিধায় ভেতরে ঢুকতে চাইলাম। গেস্ট আমাকে বলেছিলেন তিনি ইতিমধ্যেই বেরিয়ে এসেছেন। তাই ভেতরে গিয়ে তাকে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু গেটে দাঁড়ানো সিকিউরিটি আমাকে আটকে দিলেন। বললেন, “টোটো বাইরে রাখবেন। গেস্ট বের হলে তখনই নিয়ে আসবেন। এখন টোটো ভেতরে ঢুকতে পারবে না।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “কিন্তু আমার গেস্ট তো ফোন করেছে। তিনি বেরিয়েও গেছেন। আমি যদি ঢুকতে না পারি, তবে তাকে আনব কীভাবে?” সিকিউরিটি স্পষ্ট জানালেন, এখন নতুন নিয়ম চালু হয়েছে। টোটো ভেতরে ঢুকতে পারবে না, সেটা যতই আগে হোক না কেন, আর নিয়ম ভাঙা যাবে না।

প্রথমে আমার মনে হলো হয়তো নিরাপত্তার কারণে এই নিয়ম করা হয়েছে। কিন্তু একটু ভেতরে তাকিয়ে দেখলাম, হোটেলের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে একের পর এক ব্যক্তিগত গাড়ি—বড় বড় SUV, সেডান কিংবা অন্যান্য দামি গাড়ি। যারা নিজেদের গাড়ি নিয়ে এসেছে, তারা দিব্যি হোটেলের ভেতরে প্রবেশ করতে পারছে। অথচ যারা কোনো ব্যক্তিগত বাহন নিয়ে আসেনি, শুধু হোটেল বুক করেছে, তাদের বাহন—টোটো বা ছোটখাটো ভাড়ার গাড়ি—বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখতে হচ্ছে।

এই দৃশ্যটা আমার মনে বড় প্রশ্ন তুলে দিল। নিয়ম যদি হয়, তবে সেটা সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়ার কথা। অথচ এখানে এক অদ্ভুত বৈষম্য চোখে পড়ল। ধনী অতিথিরা যারা নিজেদের গাড়ি নিয়ে আসে, তারা হোটেলের ভেতরে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ—যারা হয়তো পরিবার নিয়ে এসেছেন, বা একবার ঘুরতে এসেছেন, যাদের নিজেদের গাড়ি নেই—তাদের হাঁটতে হচ্ছে, তাদের কষ্ট করতে হচ্ছে।

আমি মনে মনে ভেবেছিলাম, মান্দারমনি সত্যিই উন্নত হচ্ছে। গ্র্যান্ড বিজ রিসোর্টসহ আরও অনেক হোটেল বড় বড় পরিবর্তন এনেছে। নতুন নতুন সাজসজ্জা, সুন্দর ডেকোরেশন, বড় বড় বিল্ডিং—সব কিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে পর্যটন শিল্প এগিয়ে যাচ্ছে। তাতে আনন্দই হওয়ার কথা। কিন্তু এই উন্নতির ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক সূক্ষ্ম পার্থক্য।

ধনীরা যেখানে আরাম পাচ্ছে, সাধারণ মানুষ সেখানে বঞ্চিত হচ্ছে। আর হোটেলগুলোর চোখে সেই পার্থক্যটা যেন খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। অতিথি যদি পায়ে হেঁটে ভেতরে আসতে বাধ্য হয়, তাদের কাছে সেটা নিয়ম; আর যদি অতিথির দামী গাড়ি থাকে, তবে তাকে সম্মান জানিয়ে গাড়িসহ ভেতরে ঢোকানোই হোটেলের মর্যাদা।

এই ঘটনাটা শুধু নিয়ম ভঙ্গ বা সিকিউরিটির আচরণের সমস্যা নয়। এর মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠছে মানুষের রুচিবোধ কতখানি বদলে গেছে। একসময় হোটেলগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল অতিথিকে আরাম দেওয়া। অতিথি যেন সহজে প্রবেশ করতে পারেন, কোনো অসুবিধা না হয়, সেটা দেখা হতো। কিন্তু এখন যেন প্রাধান্য পাচ্ছে সামাজিক মর্যাদা। যে বেশি ধনী, যে বেশি দামী গাড়ি নিয়ে এসেছে, তাকেই বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

এখানে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন অবশ্যই জরুরি। হোটেলগুলো আরও সুন্দর হবে, নিরাপত্তা বাড়বে, অতিথিদের জন্য আরও সুযোগ-সুবিধা থাকবে—এগুলো ভালো। কিন্তু সেই উন্নয়নের ভেতরে যদি বৈষম্য লুকিয়ে থাকে, তবে উন্নয়নের মানেই বা কী দাঁড়ায়?

আমি দেখলাম, অনেক পরিবার—বাচ্চা, বয়স্ক মানুষ বিরক্ত। অথচ যদি টোটো ভেতরে ঢুকতে পারত, তবে এই কষ্ট তাদের করতে হতো না। আসলে এটা এক রকমের ব্যবসা টিপস নেওয়ার জন্য
বিপরীতে বড় গাড়িতে করে আসা অতিথিরা আরামসে গাড়ি নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। তাদের কোনো কষ্ট নেই।

এই দৃশ্যটাই আমার মনে গভীরভাবে দাগ কাটল। বুঝলাম, সমাজের ভেতরে আজও বৈষম্য রয়ে গেছে। শুধু অর্থনৈতিক নয়, মানসিক দিক থেকেও মানুষ আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ধনী-গরিবের পার্থক্য শুধু আয়ের ভিত্তিতে নয়, সুবিধা ও সুযোগের ভিত্তিতেও তৈরি হচ্ছে।

মানুষের রুচিবোধও যেন আজকাল অদ্ভুতভাবে বদলে যাচ্ছে। আগে যে আরাম-সুবিধা সবাই পেত, আজ সেটা কেবল বিশেষ কিছু মানুষের জন্য সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখন অনেকের চোখে টোটো হয়তো “সাধারণ মানুষের বাহন”—তাই সেটাকে ভেতরে ঢোকানো মানে হোটেলের আভিজাত্য কমে যাওয়া। কিন্তু ভুলে যাওয়া হচ্ছে যে সেই একই টোটোই অনেক অতিথির জন্য সবচেয়ে বড় ভরসা।

আমি মনে করি, সমাজে প্রকৃত উন্নতি তখনই হবে যখন সুবিধা শুধু ধনীদের হাতে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সবার জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত হবে। হোটেল হোক বা অন্য যে কোনো ক্ষেত্র, অতিথিকে আলাদা করে দেখার মানসিকতা যতদিন না বদলাবে, ততদিন উন্নতির আসল মানে বোঝা যাবে না।

দিনের শেষে আমি আবার টোটো নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। গেস্ট হেঁটে হেঁটে গেট পর্যন্ত এলেন। তিনি কিছুটা বিরক্তই ছিলেন—কারণ ব্যাগপত্র নিয়ে হাঁটা তার পক্ষে সহজ ছিল না। আমাকে বললেন, “আগে তো ভেতরে ঢুকতে পারতাম, এখন এই নতুন নিয়ম কেন?” আমি শুধু মৃদু হেসে উত্তর দিলাম, “নিয়ম বদলে গেছে দাদা, আর নিয়ম মানতে হচ্ছে আমাদের।”

কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি ভীষণ কষ্ট পেলাম। আমি বুঝলাম, এ নিয়ম আসলে নিরাপত্তার নয়, বরং রুচিবোধের বদল। ধনীদের জন্য বিশেষ সুবিধা রাখা আর গরিব বা সাধারণদের জন্য বাড়তি কষ্ট তৈরি করা—এই বৈষম্যই এখন আধুনিক সমাজের নীরব বাস্তবতা।

আজকের এই অভিজ্ঞতা আমাকে শেখালো, উন্নয়ন মানেই সমান সুযোগ নয়। বরং অনেক সময় উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্যও বাড়ে। মানুষের রুচিবোধ যতই আড়ম্বরময় হোক না কেন, যদি তাতে সমতা না থাকে, তবে সেই রুচি কেবলই একতরফা। আর সেটাই আমি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করলাম—মান্দারমনির এক হোটেলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে।

Add Comment

Click here to post a comment

About Author

admin

আমি প্রদীপ কুমার জানা, পেশায় একজন ব্লগার ও কনটেন্ট ক্রিয়েটর। প্রতিদিন নতুন খবর, সিরিয়ালের আপডেট, এবং ট্রেন্ডিং বিষয় নিয়ে লিখি NewPost.in-এ। আমার লেখা পাঠকদের জন্য তথ্যবহুল ও আপডেটেড রাখতে সবসময় চেষ্টা করি।
আমার ফেসবুক: Serial With Pradip

Log In

Forgot password?

Forgot password?

Enter your account data and we will send you a link to reset your password.

Your password reset link appears to be invalid or expired.

Log in

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.