ICDS কর্মীদের দাবি উপেক্ষিত, পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ অব্যাহত
পুষ্টি খাতে বাজেট বরাদ্দ ও স্থায়ী চাকরির দাবিতে কলকাতায় ICDS কর্মীদের বিক্ষোভ
পশ্চিমবঙ্গের ইন্টিগ্রেটেড চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস (ICDS) প্রকল্পের আওতাধীন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকারা দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত বাজেট বরাদ্দ ও চাকরির নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে রাজ্য সরকারের বাজেট ঘোষণার পর বহু মাস পেরিয়ে গেলেও বাস্তবে কোনো সুবিধা না পাওয়ায় তাঁরা কলকাতায় বিক্ষোভে নেমেছেন।
গত সপ্তাহে কলকাতার রাজপথে ICDS কর্মীরা বড় পরিসরে বিক্ষোভ মিছিল ও ডেপুটেশন দেন। এই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেয় পশ্চিমবঙ্গ অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকা ইউনিয়ন এবং অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টার (AIUTUC)-এর সঙ্গে যুক্ত সমাজতান্ত্রিক ঐক্য কেন্দ্র (কমিউনিস্ট)। তিনটি বড় মিছিলের মাধ্যমে তাঁরা রাজ্যপাল, রাজ্য সচিবালয় ‘নবান্ন’ এবং বিকাশ ভবন (যেখানে শিশু ও নারী কল্যাণ দপ্তর রয়েছে) – এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে স্মারকলিপি জমা দেন।
দীর্ঘদিনের বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম
ICDS কর্মীরা মূলত সমাজের প্রান্তিক শিশু, গর্ভবতী মহিলা এবং প্রসূতি মায়েদের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য ও স্বাস্থ্য সচেতনতা পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে থাকেন। এই কর্মীরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রাথমিক স্তরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলেও তাঁদের চাকরি এখনো অস্থায়ী ও স্বল্পভাতা নির্ভর।
AIUTUC নেত্রী নন্দা পাত্রা জানান, “আমরা বছরের পর বছর ধরে স্বল্প বেতনে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের স্থায়ী কর্মী হিসেবে স্বীকৃতি নেই, পেনশন নেই, মৃত্যুজনিত কোনো বীমা নেই। অথচ আমরা কোভিড পরিস্থিতিতেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছি।”
ইউনিয়নের সম্পাদক মাধবী পণ্ডিত বলেন, “শান্তিপূর্ণ উপায়ে আমরা আমাদের দাবি জানাচ্ছি। কিন্তু যদি সরকার আমাদের দাবি না মানে, তাহলে আমরা বৃহত্তর ধর্মঘটের দিকে যেতে বাধ্য হবো।”
২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের জন্য ফেব্রুয়ারি মাসে উপস্থাপিত বাজেটে রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছিল যে প্রায় ৭০,০০০ জন ASHA ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীকে স্মার্টফোন কেনার জন্য ₹২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনকারী ICDS কর্মীরা অভিযোগ করেছেন যে বাজেট বরাদ্দের পাঁচ মাস পরেও তাঁরা কোনো সুবিধা পাননি।
মুর্শিদাবাদের ICDS কর্মী আরিফা বেগম, যিনি নবান্ন অভিযানে নেতৃত্ব দেন, বলেন, “আমাদের বেশিরভাগ কাজ এখন অনলাইনে করতে হয়। অথচ আমাদের হাতে ভালো স্মার্টফোন নেই। রাজ্য সরকার ₹১৬৭ টাকা মোবাইল রিচার্জ ভাতা দেয়, যা বর্তমান বাজারে পর্যাপ্ত নয়। এত কম রিচার্জে আমরা ডেটা চালিয়ে কাজ করব কীভাবে?”
তিনি আরও বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী কেবল আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু মাটিতে তার কোনো প্রতিফলন নেই। আমাদের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা না থাকলে মা ও শিশু – উভয়ই তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।”
স্থায়ী নিয়োগ, পেনশন ও বীমা – কর্মীদের প্রধান দাবি
আন্দোলনকারী ICDS কর্মীরা দাবি করছেন যে তাঁদের স্থায়ী কর্মী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো চালু করতে হবে। বর্তমান সময়ে তারা অনারিয়ামের ভিত্তিতে সামান্য অর্থ পান, যা তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের খরচ বহন করতে অক্ষম।
AIUTUC নেত্রী নন্দা পাত্রা বলেন, “একজন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী প্রতিদিন সকালে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের খোঁজ রাখেন, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য যাচাই করেন, পুষ্টিকর খাবার বিতরণ করেন। অথচ মাসশেষে তাঁদের যা মজুরি দেয়া হয়, তা শ্রমের তুলনায় অপমানজনক। তাঁদের জন্য মৃত্যুকালে বীমা ও অবসরে পেনশন চালু করাও অত্যন্ত জরুরি।”
ভারতজুড়ে বঞ্চনার চিত্র
এ সমস্যা শুধু পশ্চিমবঙ্গেই সীমাবদ্ধ নয়। দেশের প্রায় সব রাজ্যেই অঙ্গনওয়াড়ি ও ASHA কর্মীরা একই রকমভাবে বঞ্চনার শিকার। তাঁদের কোনো নির্ধারিত চাকরি নেই, চাকরির সুরক্ষা নেই, নেই সরকারি কর্মচারীদের মতো সুযোগ-সুবিধা। ফলত, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক বার এই কর্মীরা প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন।
ASHA ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। তাঁরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সংক্রান্ত তথ্য ও পরিষেবা পৌঁছে দেন। তাঁদের শ্রম ছাড়া জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনেক কাজই অচল হয়ে পড়ে।
ভবিষ্যতের আন্দোলনের ইঙ্গিত
ICDS কর্মীদের আন্দোলন এখনো শান্তিপূর্ণ পর্যায়ে আছে, তবে তাঁরা জানিয়েছেন যে সরকার যদি দাবি না মেনে চলে, তাহলে তাঁরা আগামী দিনে বৃহত্তর ধর্মঘটে যাবেন। এতে রাজ্যের শিশু পুষ্টি ও মাতৃস্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
বিক্ষোভরত কর্মীরা বলেছেন, “আমরা কোনো ভিক্ষা চাই না। আমাদের প্রাপ্য সম্মান ও ন্যায্য পারিশ্রমিক চাই। যখন রাজনৈতিক নেতারা কোটি কোটি টাকার বাজেট ব্যয় করতে পারেন, তখন ICDS কর্মীদের জন্য সামান্য বরাদ্দও কীসের এত দেরি?”
স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতের এই প্রথম স্তরের কর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতি সরকার যদি যথাযথ গুরুত্ব না দেয়, তাহলে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভিত কেঁপে উঠবে। শিশু ও মায়েদের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে গেলে প্রথমে যাঁরা মাঠে কাজ করছেন, তাঁদের জীবন ও চাকরির সুরক্ষা দিতে হবে।
বর্তমানে ICDS কর্মীদের দাবি শুধু তাঁদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষার নয়, বরং সমগ্র সমাজের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সুরক্ষার প্রশ্নেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্য সরকারের উচিত অবিলম্বে তাঁদের দাবি বিবেচনা করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে স্বাস্থ্য পরিসেবার এই গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ টিকে থাকতে পারে ও আরও শক্তিশালী হয়।
পুষ্টি খাতে বাজেট বরাদ্দ ও স্থায়ী চাকরির দাবিতে কলকাতায় ICDS কর্মীদের বিক্ষোভ

Add Comment